দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে গণমাধ্যম পরিচালিত হয়৷ বিশ্বে এমন কোন গণমাধ্যম ব্যবস্থা নেই যেটি সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপরীতে নিজস্ব সিস্টেম বা ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছে৷
গণমাধ্যম দেশীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি সবসময় এদেশে সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকতার মানকে প্রভাবিত করেছে। এখনো সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকরা অনেকটাই রাজনীতি প্রভাবিত। যা এদেশের গণমাধ্যমের বিকাশের অন্যতম অন্তরায়।
আবার বিগত বছরগুলোতে বেসরকারিকরণ বা উদারনৈতিক অর্থনীতির ঢেউ গণমাধ্যম শিল্পকে স্পর্শ করলেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সংবাদপত্র কেন বিকশিত হয়নি এর উত্তর আমরা সবাই অল্প-বিস্তর জানি।
সরকারি গোপনীয়তা আইন বা একসময়ের বিশেষ ক্ষমতা আইন, বা বর্তমানের ডিজিটাল নিরাপত্তা, তথ্য প্রযুক্তি আইন ইত্যাদি আইনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দেশের সাংবাদিকরা স্বাধীন দেশে খুব কম ক্ষেত্রেই মুক্ত সাংবাদিকতার আইনগত এক সহায়ক পরিবেশ পেয়েছেন। দেশে অন্তত ২০টি আইন, ধারা, নীতিমালা মিডিয়ার ওপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করছে। অথবা ৩২টি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে ৪৮টি গণমাধ্যম। দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার চড়াই-উৎরাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদেশে গণমাধ্যমের বিকাশের ইতিহাস। সুতরাং সাংবাদিকতায় আমাদের অর্জন-বিয়োজন প্রভাবিত হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনগত পরিবেশ দ্বারা।
আইনগত পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া আরও যে কয়েকটি ব্যাপার সাম্প্রতিকালে দেশের সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের বিস্তার ও করপোরেট পুঁজি। তথ্য ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমের আধিপত্য আইনি কাঠামোয় সংকুচিত ও নিয়ন্ত্রিত মূলধারার গণমাধ্যমকে এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে ফেইক নিউজের আধিপত্যের কথা আমরা যতই বলি না কেন, বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক, দেশি-বিদেশি নিউজ পোর্টাল, আইপিটিভি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য, মতামত ইত্যাদি শেয়ার করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখালেখি বা আলোচনা করে অনেক বিশ্লেষকই সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছেন। মূলধারার সাংবাদিকদের যেখানে বিবেচনা করে রয়েসয়ে লিখতে হয়, সেখানে সামাজিক মাধ্যমে বল্গাহীন আলোচনা মানুষকে সামাজিক মাধ্যমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের জন্য গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকে। তারপরও কিছু কিছু মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠতার চর্চা অব্যাহত থাকলেও, বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত।”
এর কারণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ “অন্যদেরকে দায়ী করার আগে নিজেদের দায়ও এড়ানো যায় না। এখন গণমাধ্যমে যারা কাজ করছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন যে, এই খবরটি প্রচার করা হবে, অন্যটি নয়। এছাড়াও ওপরের মহল থেকেও নানা ধরণের চাপ এড়িয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
মিডিয়ার ব্যবসায়িকভাবে টিকিয়ে রাখার কৌশলের অংশ হচ্ছে বাকস্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক তথ্য অধিকার হরণকারী কলা কানুন মেনে চলার আবশ্যকতা। এখানে সরকারি দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা সচিবদের অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে, প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে, রাষ্ট্রীয় খরচের মডেল নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না। ফলে চুরি, লুণ্ঠন, জালিয়াতি, ঘুষ, তদবির, চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক দুর্বৃত্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র মৌলিক দায়বদ্ধতার বিষয় অনুপস্থিত। কাউকে পদ থেকে সরিয়ে দিলেই পরে তার বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ তোলা যায়, তা-ও সরকারের নির্দেশিত কিংবা সহ্যের সীমার মধ্যে থেকে। ফলে সংবাদমাধ্যম ‘গণমানুষ’কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না বরং প্রশাসনসহ ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের সার্বিক রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে।
Leave a Reply